Skip to main content

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর মান ৪

প্রো ঃ নতুন সামাজিক ইতিহাস বলতে কী বোঝো? 
উঃ 1960 ও 1970- এর দশকে নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক আন্দোলনের কারণে অতীতের ঘটনাবলীর নতুন ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এর সূচনা হয়। একসময় ইতিহাস বলতে রাজা মহারাজাদের যুদ্ধ-বিগ্রহ ও তাদের কাজ কর্ম ছিল। কিন্তু বর্তমানে ইতিহাস হল একটা দেশ বা জাতির সামগ্রিক জীবনযাত্রা।
                                 পাশ্চাত্য দেশের সমাজের অবহেলিত দেশ গুলির উপর জোর দিয়ে ইতিহাস রচনা করা হতো। এইভাবে গড়ে উঠলো নতুন সামাজিক ইতিহাস সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও তাদের জীবনযাপন,জাতি,বর্ণ ও জাতিবিদ্বেষ হিংসা ও সম্প্রীতি হয়ে উঠল নতুন সামাজিক ইতিহাস এর আলোচ্য বিষয়বস্তু।

প্রশ্নঃ ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য কি ছিল? বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো এবং এর  চরিত্র ও গুরুত্ব আলোচনা করো
উঃ ওয়াহাবি আন্দোলন : ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন দিল্লির বিখ্যাত মুসলিম সন্ত শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তার পুত্র আজিজ। তবে ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃ ত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রায়বেরিলির অধিবাসী সৈয়দ আহমদ।
ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য : 
i) ইসলামধর্মের সংস্কার : ‘ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত নাম হল ‘তারিকা-ই-মহম্মদীয়া’ অর্থাৎ ইসলামধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মহম্মদ প্রদর্শিত পথ। ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামধর্মের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কার দূর করে মহম্মদের নির্দেশ অনুসরণ করে ইসলামধর্মের সংস্কার করা।
ii)  ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজদের বিতাড়ন : ওয়াহাবি আন্দোলনকারীরা বিধর্মী ইংরেজ-শাসিত ভারতকে ‘দার-উল-হারব’ (শত্রুর দেশ) বলে অভিহিত করত। তাই তারা ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষ থেকে বিধর্মী ইংরেজদের বিতাড়িত করার জন্য আন্দোলন করেছিল।
iii)  অত্যাচারী জমিদারদের উচ্ছেদ : ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল অত্যাচারী জমিদারদের উচ্ছেদ করা। এই কারণে পাঞ্জাবের অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে সৈয়দ আহমেদ যুদ্ধ করে পেশোয়ার দখল করেছিলেন এবং বাংলায় তিতুমির পুড়ার জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
iv)   নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শ: ওয়াহাবি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল এক সহজসরল জীবনযাত্রা এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন: বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন মির নিশার আলি, যিনি তিতুমির নামে অধিক পরিচিত। তিতুমির ২৪ পরগনা জেলার বাদুড়িয়া থানার অন্তর্গত হায়দারপুর গ্রামের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ৩৯ বছর বয়সে মক্কায় হজ করতে গিয়ে সৈয়দ আহমদের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং দেশে ফিরে ইসলামধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই আন্দোলন কৃষক আন্দোলন’-এ পরিণত হয়েছিল। বারাসত অঞলে তিতুমিরের এই আন্দোলন বারাসত বিদ্রোহ’ নামেও পরিচিত।
তিতুমিরের আন্দোলনের মূল কথা: তিতুমিরের আন্দোলনের মূল কথা ছিল—
I. একমাত্র আল্লাহকে মান্য করতে হবে।
II.  মুসলমানদের ইসলামধর্মবহির্ভূত সংস্কার পরিত্যাগ করতে হবে।
III.  অনুগামীদের দাড়ি রাখতে হবে।
IV. অত্যাচারী জমিদারদের রাজস্ব দাবির বিরোধিতা করতে হবে।
তিতুমিরের বিরুদ্ধে জমিদারদের প্রতিক্রিয়া : তিতুমিরের প্রভাবে ২৪ পরগনা, নদিয়া, মালদহ, রাজশাহি, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকরা ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করলে জমিদার, নীলকর সাহেব ও মুসলমান মোল্লারা তিতুমিরের বিরোধিতা শুরু করে। পুড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব  রায় তিতুমিরের অনুগামীদের দমন করার জন্য দাড়ির উপর ২.৫ টাকা কর ধার্য করেছিলেন। ফলে জমিদারের সঙ্গে তিতুমিরের অনুগামীদের সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল।
বারাসত বিদ্রোহ : তিতুমির বারাসতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজেকে ‘স্বাধীন বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন ও মইনউদ্দিন নামে এক অনুগামীকে প্রধানমন্ত্রী এবং ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে প্রধান  সেনাপতি নিযুক্ত করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার পরিকল্পনা করেন। তিনি নারকেলবেড়িয়ার সদর দপ্তরে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে ওই অঞ্চলের জমিদারদের কাছে রাজস্ব দাবি করেন। এটি ইতিহাসে ‘বারাসত বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত।
বারাসত বিদ্রোহের অবসান : তিতুমিরের বিরুদ্ধে স্থানীয় জমিদার ও নীলকর সাহেবরা গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্কের শরণাপন্ন হলে 1831 খ্রিস্টাব্দে লর্ড বেন্টিং তার বিরুদ্ধে  এক অভিযান প্রেরন করেন এবং কামানের আঘাতে বাঁশেরকেল্লা ধ্বংস হয়। তিতুমীর ও তার কয়েকজন অনুগামী বীরের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেন বন্দি সৈন্যদের ফাঁসি হয় এবং অনেকে দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড ভোগ করেন।
তিতুনিবের আন্দোলনের চরিত্র :  তিতুমিরের আন্দোলনের চরিত্র নিয়েও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। সমকালীন লেখক বিহারীলাল সরকার, কুমুদনাথ মল্লিক তিতুমিরের আন্দোলনকে ‘ধর্মোন্মাদ মুসলমানদের কাণ্ড’ এবং হিন্দু-বিরোধী আন্দোলন বলে চিহ্নিত করেছেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার একে নিছক সাম্প্রদায়িক আন্দোলন বলেছেন।  অপরপক্ষে হান্টার, থর্নর্টন প্রমুখ ঐতিহাসিক এতে কোন সাম্প্রদায়িকতা দেখতে পাননি। ডব্ল. সি. স্মিথ,  ডঃ কুয়েমুদ্দিন আহমদ, নরহরি কবিরাজ  প্রমুখ এর মধ্যে জমিদার, নীলকর ও ইংরেজ বিরোধিতা লক্ষ্য করেছেন। ড. বিনয়ভূষণ চৌধুরী  বলেন যে, তিতুমিরের সংগ্রাম ছিল জমিদারের অনাচারের বিরুদ্ধে। সে যুগে জমিদারদের অধিকাংশই হিন্দু হওয়ায় এই আন্দোলনকে হিন্দু-বিরোধী বলে মনে হতে পারে, কিন্তু মুসলিম জমিদারদের তিনি ছেড়ে দেননি। নিম্নবর্ণের বহু হিন্দু তাকে সমর্থন করত।
গুরুত্ব: ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ওয়াহাবি আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম।তিতুমিরের নেতৃত্বে পরিচালিত ওয়াহাবি আন্দোলন ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও এটি কৃষক বিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহণ করেছিল।অত্যাচারী জমিদার ও নীলকর সাহেবদের হাতে নির্যাতিত মানুষদের সংগঠিত করে তিতুমির বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক প্রেরিত ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি প্রাণপণ সংগ্রাম করেছিলেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে, তিতুমিরের বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানো। ড. শশীভূষণ চৌধুরী বলেছেন যে, এই বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি ছিল কৃষকরা এবং এই বিদ্রোহ ছিল আসলে ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত কৃষক বিদ্রোহ।যাইহোক পরবর্তীকালে এই আন্দোলনে ধর্মীয় স্পর্শ লক্ষ্য করা গেলেও এই আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম দরিদ্র কৃষক জমিদার নীলকর সাহেব এবং ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এবং হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে ভারতে এক মিশ্র-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল।তাই এই আন্দোলনের গুরুত্ব কে অস্বীকার করা যায় না।

প্রশ্নঃ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা সংক্ষেপে আলোচনা কর।

উঃ 1942 খ্রিস্টাব্দের 9 আগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে ভারতের হাজার হাজার নারী এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে থাকে। 9 আগস্ট ভোর রাতেই কংগ্রেস কার্যনির্বাহক কমিটির সকল সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। একমাত্র নারীদের মধ্যে সরোজিনী নাইডু কে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের যোগদান আইন অমান্য আন্দোলনের মতো পরিকল্পিত ও কর্মসূচিভিত্তিক না হলেও নারিরা বিভিন্নভাবে এই আন্দলোনে যোগদানকরেছিল।

 অহিংস আন্দোলন সংগঠিত করে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সুচেতা কৃপালনী আবার অরুনা আসফ আলি এ আন্দোলনের বৈপ্লবিক কাজকর্মকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন।এসময় উষা মেহতা গোপনে জাতীয় কংগ্রেসের বেতার কেন্দ্র পরিচালনা করতেন।এসময় মহিলা স্বেচ্ছাসেবী দ্বারা গঠিত ভগিনী সেনার সদস্যরা খুবই বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রদর্শন করেছিলেন। যেমন আসামের 14 বছরের কিশোরী কনকলতা বড়ুয়া পাঞ্জাবের গৃহবধূ ভোগেশ্বরী ফুকননী প্রমুখ বিরঙ্গনা মহিলার নাম ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।
     বাংলায় ভারতছাড়ো আন্দোলনের সময়ে মেদিনীপুরের মহিলারা বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিল। গান্ধী বুড়ি নামে খ্যাত মাতঙ্গিনী হাজরা 1942 খ্রিস্টাব্দের 29 সেপ্টেম্বর তমলুক থানা দখল করার নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে জখম হন ও পরে মৃত্যুবরণ করেন।বীরভূমের শান্তিনিকেতন অঞ্চলে এই আন্দোলনকে সংগঠিত করতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন সুনিতা সেন, নন্দীতা কৃপালনী, এলা দত্ত, লাবণ্যপ্রভা দত্ত, মায়া ঘোষ প্রমুখ।

 যাইহোক, নারীদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে গান্ধীজী মন্তব্য করেছেন যে “ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস যখন লিখা হবে নারিদের বিরত্বের কথা সর্বাধিক স্থান গ্রহনকরবে”।

প্রশ্নঃ নারী শিক্ষার প্রসারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান লেখো।
উঃ ভূমিকা:-বাংলাদেশে নারী শিক্ষার বিস্তারে যে সকল মনীষী নিরলস প্রয়াস চালিয়েছিলেন সমাজসংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাদের মধ্যে স্মরণীয়। ইতিপূর্বে খ্রিস্টান মিশনারি ও কিছু উদার ইংরেজের  ব্যক্তিগত উদ্যোগে নারী শিক্ষার সূচনা হলেও বিদ্যাসাগরই ছিলেন বাংলা তথা ভারতের নারী শিক্ষা বিস্তারের পথিকৃৎ।
উদ্দেশ্য : নবজাগরণের প্রতিমূর্তি এই সংস্কৃত পণ্ডিত উপলব্ধি করেছিলেন একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতীয় নারীর মুক্তিলাভ সম্ভব। নারীর উন্নতি ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।

 হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় : ব্রিটিশ সরকারের আইন সচিব ড্রিঙ্কওয়াটার বিথুন 1849 খ্রিস্টাব্দে ‘হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলে বিদ্যাসাগর তাকে সাহায্য করেন। এটি ছিল ভারতের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। তিনি ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক। বর্তমানে এটি ‘বেথুন স্কুল’ নামে পরিচিত।

স্ত্রী-শিক্ষা সম্মিলনী গঠন : নারীদের মধ্যে শিক্ষা সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তিনি বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলায় গড়ে তোলেন স্ত্রী-শিক্ষা সম্মিলনী।বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তিনি নারী শিক্ষার সপক্ষে লেখালেখি শুরু করেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে অভিভাবকদের বুঝিয়ে ছাত্রী সংগ্রহের নিরলস প্রচেষ্টা চালান।

বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন : 1854 খ্রিস্টাব্দে উডের নির্দেশনামায় স্ত্রী-শিক্ষা বিস্তারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বাংলার ছোটোলাট স্যার ফ্রেডারিক হ্যালিডে কর্তৃক ঈশ্বরচন্দ্র দক্ষিণবঙ্গের বিদ্যালয় পরিদর্শক নিযুক্ত হন। স্ত্রী-শিক্ষায় সরকারের আগ্রহ দেখে তিনি 1857 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1858 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে মাত্র সাত মাসের মধ্যে নিজ ব্যয়ে নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি ও মেদিনীপুর জেলায় 35টি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এগুলিতে প্রায় 1300 ছাত্রী পড়াশুনো করতো। কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন-এর নতুন ডিরেক্টর গর্ডন ইয়ং নতুন স্কুলগুলিকে অর্থ বরাদ্দ করতে অস্বীকার করলে তিনি পরিদর্শক ও সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে ইস্তফা দেন। তবে ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালিয়ে বিদ্যালয়গুলির জন্য কিছু আর্থিক সহায়তা আদায় করেন।
মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন : বিদ্যাসাগর নিজ উদ্যোগে ও খরচে কলকাতায় ‘মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এটি ‘বিদ্যাসাগর কলেজ’ নামে
ভগবতী বিদ্যালয় : মাতা ভগবতী দেবীর স্মৃতিতে তিনি 1890 খ্রিস্টাব্দে নিজ জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে ভগবতী বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
উপসংহার : স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, রামকৃষ্ণের পর, আমি বিদ্যাসাগরকে অনুসরণ করি (After Ramakrishna, I follow Vidyasagar.) নারীশিক্ষায় বিদ্যাসাগরের অবদান ছিল অসামান্য। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “বিধাতা বিদ্যাসাগরের প্রতি বঙ্গভূমিকে মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন”। তিনিই ছিলেন বাংলার নবজাগরণের এক উজ্জ্বল পথিকৃৎ।

প্রশ্নঃ কী কারনে নীল বিদ্রোহ হয়েছিল ? এই বিদ্রোহের গুরুত্ব গুলি আলোচনা করো ।
উঃ- ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নীল চাষীরা নীলচাষ তথা নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল ,তা নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত । এই বিদ্রোহের পিছনে অনেক কারন কাছ করেছিল সেগুলি হল ।
নীলবিদ্রোহের কারন :-
১.নীলকরদের অত্যাচার :- নীলকরসাহেবরা নীল চাষীদের নানাভাবে অত্যাচার করে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নীল চাষ করতে বাধ্য করত । এই অত্যাচার থেকে মুক্তির আশায় তারা বিদ্রোহ শুরু করে ।
২.দাদন প্রথা :- নীলকররা চাষীদের দাদন বা অগ্রিম অর্থ দিয়ে তাদেরকে নীল চাষ করতে বাধ্য করত । একবার কেউ দাদন নিলে সে আর নীল চাষের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারত না ।
৩.প্রতারণা ও কারচুপি :- নীলকররা চাষীদের কাছ থেকে নীল কেনার সময় নীলের ওজন কম দেখাত । চাষীদের কাছ থেকে কমদামে নীল ক্রয় করত । তাছাড়া জোর করে বিভিন্ন ভাবে অর্থ আদায় করত ।
৪.পঞ্চম আইন :- ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক পঞ্চম আইন পাশ করে ঘোষণা করেন যে , কোনো চাষী দাদন নিয়ে নীল চাষ না করলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে ।এর ফলে চাষীদের ওপর অত্যাচার অনেক বেড়ে গিয়েছিল ।
৫. পত্র - পত্রিকার প্রভাব :- নীল চাষীদের ওপর অত্যাচারের কাহিনী সে সময়কার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে । হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা, দীনবন্ধু  মিত্রের নীলদর্পণ নাটক এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ।
এইসব কারনে নীল চাষিরা নীল বিদ্রোহের সূচনা করেন । ক্রমে ক্রমে এই বিদ্রোহ বর্ধমান, বাঁকুড়া ,মালদা , মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর, ফরিদপুর, খুলনা প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে ।
নীল বিদ্রোহের ফলাফল /গুরুত্ব/ তাৎপর্য :-
নীল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল অনেক ।
১. এই বিদ্রোহের ফলে সরকার ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ৩১ ডিসেম্বর নীল তদন্ত কমিশন গঠন করেন ।
২. কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে নীল চুক্তি আইন রদ করা হয় এবং নীল চাষ সম্পূর্ণ চাষিদের ইচ্ছাধীন করা হয় ।
৩. নীল বিদ্রোহের সাফল্য বাঙালির জাতীয়তাবাদ প্রসারে সহায়তা করেছিল ।
৪. সর্বোপরি নীল বিদ্রোহ সর্ব প্রথম ভারতবাসীকে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা শিখিয়েছিল ।
অবশেষে বলা যায়, নীল বিদ্রোহ বাঙালি সমাজে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল । বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীরাও নীল বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিল ।

প্রশ্নঃ ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ বিশ্লেষণ করো।
        অথবা
উনিশ শতকে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় চেতনার উন্মেষের কারণগুলি আলোচনা করো।
উত্তর : ভূমিকা : জাতীয় চেতনা থেকেই জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। ওঁপনিবেশিক শাসনের গোড়ার দিকে ভারতে কোনো জাতীয়তাবাদী চেতনা ছিল না। বিদেশি শাসনের ফলশ্রুতি হিসেবেই আধুনিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ শুরু হয়।
.
ইউরোপীয় প্রভাব : (১) আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৪ থ্রি), (২) জাপানের সাফল্য ও অগ্রগতির ভারতীয়দের স্বাধীন চিন্তা শত্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। (৩) ফরাসি বিপ্লব (১৯৭০ থ্রিঃ)। (৪) তাছাড়া রাশিয়ার নিহিলিস্ট আন্দোলনও বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
কারণসমূহ :
১। ব্রিটিশ অপশাসন : ব্রিটিশ অপশাসনের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের সর্বস্তরের মানুষের মনে অসম্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল। এই অসন্তোষ থেকেই জাতীয় চেতনা জাগ্রত হতে থাকে।
২। জাতিগত বৈষম্য : শাসক ইংরেজ ও শাসিত ভারতবাসীর মধ্যে জাতিগত বৈষম্য সামাজিক ব্যবধান সৃষ্টি করেছিল। ইংরেজরা ভারতীয়দের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত। তারা সিপাহি, দেশীয় সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করত।
৩। পাশ্চাত্য শিক্ষা : মিশনারি ও সরকারি উদ্যোগে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়। ফলে ভারতবাসী ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হয়। বিশেষ করে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব, ইউরোপীয় রাষ্ট্রদর্শন শিক্ষিত ভারতীয়দের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।
৪। অতীত এঁতিহ্য : ইউরোপীয় পণ্ডিত উইলিয়ম জোনস, ম্যাক্সমুলার ও ভারতীয় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ভান্ডারকারের চেষ্টায় ভারতের সমৃদ্ধ অতীত এঁতিহ্ প্রচারিত হয়।
৫। সাহিত্য : পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব এদেশের সাহিত্যের ওপর পড়েছিল। উপন্যাস, কাব্য, নাটক, প্রবন্ধ দেশবাসীর কাছে আশা-আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করে, প্রতিবাদের মানসিকতা গড়ে তোলে।
৬। পত্রপত্রিকা : সাহিত্যের মতো সংবাদপত্রও জাতীয়তাবাদের উন্মেযে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। শ্রীরামপুর মিশনারিদের “দিগদর্শন’, “সমাচার দর্পণ”, গঙ্জাকিশোর ভট্টাচার্যের “বেঙ্জল গেজেট” রামমোহন রায়-এর “সম্বাদ কৌমুদী’, কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের “সংবাদ প্রভাকর’ প্রভৃতি
৭। যোগাযোগ ব্যবস্থা : ইংরেজ সরকার নিজেদের স্বার্থে রেলপথ, সড়কপথ, টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিরাট উন্নতি ঘটে।
৮। দেশীয় শিল্পের অবক্ষয় : ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার ইংল্যান্ডের শিল্পায়ন, অবাধ বাণিজ্য শত্তি, সরকারের শুষ্কনীতি দেশের শিল্পের অবক্ষয় ঘটায়।
উপসংহার : উপরোস্ত কারণ ছাড়াও যোগাযোগ ব্যবস্থা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। ভারতের বিভিন্ন অঞ্লের মানুষ একে অন্যকে চিনতে ও বুঝতে পারে৷ প্রাদেশিকতার সীমা ছাড়িয়ে ভারতবাসীর মধ্যে এঁক্য গড়ে ওঠে।

প্রশ্নঃআইন অমান্য আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলনের বণনা দাও।
উত্তর : ভূমিকা : অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে আইন অমান্য আন্দোলনের সময় শ্রমিক আন্দোলনের সংখ্যা ও তীব্রতা তুলনায় কম ছিল। কিন্তু কৃষক আন্দোলন সেই অভাব পূরণ করতে অনেকাংশেই সফল হয়। এই আন্দোলন ছিল অহিংস। লবণের মতো নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য আন্দোলনের বিষয় হওয়ায় সর্বশ্রেণির মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দেয়। বিশেষত কৃষকশ্রেণি এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
আইন অমান্য আন্দোলন চলাকালীন ভারতীয় কৃষক বিদ্রোহ :
১। স্থানীয় নেতৃত্ব : আইন অমান্য আন্দোলনের প্রথম দিকেই কংগ্রেসের নেতৃত্বস্থানীয়দের গ্রেফতার করা হয়। তখন আন্দোলন চালানোর দায়িত্ব এসে পড়ে স্থানীয় নেতাদের ওপর । তারা আন্দোলন আরও বেশি হিংসাত্মক করে তোলেন।
২। ধনী কৃষকদের ভূমিকা : বাংলায় কংগ্রেসি আন্দোলনের অন্যতম ছিলেন ধনী কৃষকরা। তারা একদিকে দরিদ্র ভাগচাষি বা বর্গাদার চাষিদের অধিকারের যেমন বিরোধিতা করেন। অন্যদিকে তেমন বিরোধিতা করেন বড়ো জমিদারদেরও ৷ এঁদের উদ্যোগে আরামবাগ, কীঁথি বা তমলুক অঞ্লে অহিংস আইন অমান্য আন্দোলন গড়ে ওঠে।
৩। জমিদারদের কৃষক বিরোধিতা : পূর্ববঙ্গে কৃষক আন্দোলনে ব্রিটিশ শাসনের পাশাপাশি জমিদারদেরও বিরোধিতা করা হয়। হিন্দু ও মুসলমান কৃষকরা একত্রে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। স্থানীয় মহাজন ও জমিদারের বাড়িতে হামলা চালানো হয়।
৪। বাংলা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত ও মাদ্রাজ প্রদেশে কৃষক আন্দোলন : ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গণ আইন অমান্য আন্দোলনের পর্বে এই অঞ্লগুলিতে কংগ্রেস কর্মীদের নেতৃত্বে কৃষকেরা খাজনা বন্ধের আন্দোলন শুরু করে। বাংলায় “নিখিল বঙ্ঞা প্রজা পার্টি” নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এইসব অঞলে সরকারি দমননীতি চরম আকার ধারণ করে। এইসব SGT গ্রামে গ্রামে পুলিশ সন্ত্রাস শুরু হয়। জমিদাররা পুলিশ-এর সহায়তায় অনেক বাড়ি ঘর ধ্বংস করে এবং তাদের সম্পত্তি লুঠ পাট করে।
৫। দক্ষিণ ভারতে কৃষক আন্দোলন : কিষাণ সভা গঠনের বিষয়ে সবরকম উদ্যোগী হয়ে অস্থবপ্রদেশের নেতা অধ্যাপক এন জি রঙ্গা। অল্পদিনের মধ্যেই নানা স্থানে এই সংস্থার শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অন্যান্য অঞলেও কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন।
৬। সারা ভারত কিষাণ সভার নামকরণ : ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই বিহারের গয়া জেলার নিয়ামতপুরে সারা ভারত কিযাণ কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। সেখানে কিযাণ কংগ্রেসের নামকরণ হয়-_’সারা ভারত কিষাণ সভা” বা নিখিল ভারত কিযাণ সভা।
৭। কিষাণ সভার দাবি ও কার্যকলাপ : ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসে কিযাণ কংগ্রেস একটি ইস্তাহার প্রকাশ করে। ১৯৩৬ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে জাতীয় কংগ্রেসের ফৈজপুর অধিবেশনে এই ইস্তাহারটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ইস্তাহারে কতকগুলি দাবি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করার কথা বলা হয় এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দাবিগুলি হল–(ক) মহাজনি প্রথার বিলোপসাধন করতে হবে। (খ) খাজনা হার ৫০ শতাংশ কমাতে হবে। (গ) বেগারপ্রথা উচ্ছেদ করতে হবে। (8) বনজ সম্পদ আহরণের পূর্ণ অধিকার দিতে হবে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে ১৯৩০-৩১ থ্রিঃ আইন অমান্য আন্দোলন ভারতীয় কৃষকদের সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহনের সাহস জুগিয়েছিল। ভারতীয় কৃষক সমাজ বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল এবং এই বৈচিত্র্যের মধ্যে এঁক্যের প্রতীক ছিলেন গান্বিজি।


প্রশ্নঃহুতোমপ্যাঁচার নক্সা গ্রন্থ থেকে উনিশ শতকের বাংলা সমাজের কী প্রতিফলন পাওয়া যায় ?
উত্তরঃ- কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত হুতোম প্যাচার নকশা গ্রন্থটি 1861 খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। কালীপ্রসন্ন সিংহ এই গ্রন্থে তৎকালীন বাঙালি সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন। এতে ব্রিটিশ আমলের কলকাতা ও তার আশপাশে অর্থসম্পদে ফুলে-ফেঁপে ওঠা এক সমাজের বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে ।
সমাজের ধ্বজাধারীদের শ্রেণিবিভাজনঃ-  এই গ্রন্থে যাদের ব্যঙ্গ করা হয়েছে তারা হলেন লেখকের সেই সময়ের অগ্রবর্তী বা ধ্বজাধারী মানুষজন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লেখক নিজেও এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। লেখক তাদের তিনভাগে ভাগ করেছিলেন।
    1)      ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও সাহেবি চালচলনের অন্ধ অনুকরণকারী।
    2)      ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কিন্তু অন্ধ অনুকরণকারী নয়।
    3)      ইংরেজি না জানা গোঁড়া হিন্দু।
তবে, এদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল এরা সকলেই কমবেশি বিভিন্ন ফন্দিফিকির করে বা অসৎ উপায়ে বিপুল অর্থ উপার্জন করে।
জাত বস্তসমূহঃ- এই গ্রন্থ থেকে সমকালীন সমাজের বাস্তব জীবন, সমকালীন সমাজে ব্যবহৃত মুখের ভাষা এবং সমাজকে প্রগতির পথে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস সম্পর্কে আমরা জানতে পারি।
সমাজের প্রতিফলনঃ-
1)  ধনীসমাজের হীনতা,কপটতা:- কালীপ্রসন্ন  সিংহ ছিলেন  উনিশ শতকের এক ধনী পরিবারের সন্তান। ফলে তিনি ধনী সম্প্রদায়ের মানুষজনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তার নক্শায় এদের হীনতা, কপটতা ও ভণ্ডামির কথা তুলে ধরেছেন ও তার বিরুদ্ধে শানিত বাণনিক্ষেপ করেছেন। তার আক্রমণের ভাষা ছিল তীক্ষ্ণ, শ্লেষাত্মক ঝাজালো।
2)   সামাজিক সংস্কার ও সংস্কারকঃ- হুতোম প্যাঁচার নকশায় উনিশ শতকের বাংলা সমাজের সতীদাহ প্রথা রোধ, বিধবাবিবাহ প্রচলন, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতি বিষয়ের নানান ঘটনার প্রতিফলন পাওয়া যায়। এইসব প্রথার বিরুদ্ধে ও প্রচলনের সপক্ষে যে আন্দোলন হয়েছিল, সে সম্পর্কেও কতিপয় নকশা রচিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতেও ভোলেননি।নকশায় যেসব মনীষীদের তিনি বিশেষভাবে স্মরণ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ডেভিড হেয়ার প্রমুখ।
3) সমকালীন  লোকসংস্কৃতিঃ- হুতোম প্যাঁচার নক্শায় লোক সংস্কৃতির অনেক উপাদান সম্পর্কে জানতে পারা যায়। মূলত এই নকশাগুলি লকায়েত কাঠামর উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। তার নকশাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— চড়ক পার্বণ, কলিকাতার বারোয়ারি পুজো, মাহেশের স্নানযাত্রা, রথযাত্রা', হুতোম প্যাচার নকশা দুর্গোৎসব, রাসলীলা প্রভৃতি। এ ছাড়াও তার বিভিন্ন নকশায় নীলের রাত্রির ব্রত, পাঁচালি, যাত্রাগান, পিঠেপার্বণ বা পৌষসংক্রান্তি, ষষ্ঠীর বাটা প্রভৃতি লোকসংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া যায়। এই সময়ের বাবুচিত্র রচনায় পাঁচালি, টপ্পা, আখড়া ইত্যাদি লকোয়েত  উপকরণকেও তিনি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।
4)  সমকালীন শিক্ষা ও সাহিত্যঃ-  উনিশ শতকের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে হুতোমপ্যাঁচার নক্সায় অনেক ভিন্নধর্মী চিত্র পাওয়া যায়। এই নকশাগুলি থেকে একদিকে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ও অন্যদিকে বাংলা ও সংস্কৃত শিক্ষার নানান কথা জানা যায়। এই সময়ের বাংলা গ্রন্থের মধ্যে যেগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, সেগুলি হল— চাণক্য শ্লোক, বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়, সীতার বনবাস, টেকচাঁদ ঠাকুরের আলালের ঘরের দুলাল প্রভৃতি।
উপসংহারঃ-কালীপ্রসন্ন সিংহ তার হুতোম প্যাঁচারনক্সায় তৎকালীন সমাজজীবন ও ব্যক্তিজীবনের ক্ষতস্থানগুলিকে চিহ্নিত করেন এবং তার নিরাময়ের কথা বলে দেশের উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করেছেন। তিনি তৎকালীন বড়োলোকদের লাম্পট্য, মাদকাসক্তি ও নানান দুষ্কর্মের নকশা রশাগুলির দ্বারা তিনি স্বজাতির কল্যাণসাধনের কথা বলেছেন।